অন্যের দোষ ধরা সহজ কিন্তু নিজের দোষ চোখেই পড়ে না!

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

অন্যের দোষ ধরতে আমরা দক্ষ, আমরা বাঙ্গালী জাতি আর কিছু না পারলেও এটা পারি। আমরা স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করেই প্রচুর সমালোচনা করতে পারি। সারা বিশ্ব যেখানে যুগের সাথে তালে তাল মিলিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। আমরা সেখানে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যের দোষ ধরার জন্য কাজের সমালোচনা করছি ও দোষ ধরছি। আমাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে নেতিবাচক বা খারাপ দিকের অবতারণা হয় বেশী।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

অন্যের সমালোচনা এবং নিজের সাফাই গাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে পারদর্শিতা তা কিন্তু সারা বিশ্বে নই, শুধু এদেশে। বিষয়ের গভীরে যাবার আগে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণার প্রয়োজন। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশের অধিবাসীরা পরিশ্রম বিমুখ এবং খুব আরাম প্রিয়। ফলে যেখানে অবসর থাকে সেখানে আলোচনা সমালোচনা স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে। আর আলোচনার জন্য কোন বিষয়বস্তু তো অবশ্যই প্রয়োজন। সহজ বিষয় হিসেবে আমরা অন্যের করা কাজকে নিয়ে আলোচনা করে থাকি। কারণ এ ক্ষেত্রে আমাদের কোন অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পরে না। এর ফলে আমরা অন্যের দোষ ত্রুটি গুলো ধরে বিচারক সাজার চেষ্টা করি।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

প্রকৃত পক্ষে আমাদের এ দেশ সোনার বাংলা। শুধু সোনালী ফসল ফলে বলে নই। মানুষের জীবন ধারণের প্রায় সব উপকরণই এ দেশে সহজ লভ্য। এখানে জীবনধারণের সব উপাদানই সুলভ এবং তা সংগ্রহে জন্য বেশী সময়, অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আমি একজন শ্রমিক হিসেবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে পরিবারের সবার জন্য খাবার জোটাতে পারছি। তাই সন্ধ্যার পর অবসর সময়টুকু চায়ের দোকানে সমলোচনা এবং আড্ডায় ব্যয় করতে সমস্যা হয় না। আমাদের হাতে প্রচুর সময় থাকার ফলে, আমরা সে সময়কে অন্যের সমালোচনায় ব্যয় করি। অন্যের দোষ ধরে বিচারক সাজার ক্ষেত্রে এটি একটি কারণ।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

তাই আমরা অবসর সময়টুকু সমালোচনায় ব্যয় করার একটা মোক্ষম সুযোগ পাই। এ কথায় অনেকেই নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করতে পারেন, তবে এটাই সত্য। ধরি, দিন মজুর হিসেবে আমি যা পারিশ্রমিক পাই তা দিয়ে আমার সংসার চলে না। তখন অতিরিক্ত ও প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের জন্য আমাকে কিছুটা সময় নদীতে মাছ ধরতে হবে। অথবা এ জাতীয় অন্য যে কোন কাজ করার চেষ্টা অবশ্যই থাকবে। এভাবে আমাদের অবসর সময়টাও কাজে লাগছে।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

এখানে আমার অন্যের সাথে আড্ডা দেয়ার ও অন্যের দোষ নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ নেই। এবার আসি আবহাওয়ার বিষয়ে। যদি এমন হতো, আমাদের দেশটির আবহাওয়া বা জলবায়ু ঠিক একটি শীত প্রধান দেশের মত। তখন আপনি আমি নিশ্চয় বিছানায় লেপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম না। কারণ জীবন ও জীবিকার জন্য আমাকে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। শীত বা ঠান্ডা বেশীর কারনে নিজের দেহকে নড়াচড়া করাতে হবে। অর্থাৎ আমার দেহের উষ্ণতা ঠিক রাখার জন্যই আমাকে প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হবে। এমন অবস্থায় অবসর সময় টুকু বাইরে চায়ের দোকানে দশজনের সাথে আড্ডা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নই।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

আমাদের জন্মগত ইচ্ছা বা প্রবণতা হলো, যারা ধনী আছি, তারা আরও ধনী হবার চেষ্টা করি। আর যারা মধ্যবিত্ত বা গরীব তারা পরিশ্রম করে মধ্যবিত্ত ও গরীবের বলয় হতে বের হবার চেষ্টা করি না। ফলে আমরা সবাই যে যেখানে আছি সেখানেই থাকতে চাই। চেষ্টার মাধ্যমে ভাগ্যের উন্নয়ন এবং অবস্থা পরিবর্তনে আমরা উৎসাহবোধ করি না। বরং এ সময়টুকু আরাম আয়েশ ও অলসতায় কাটানোর পক্ষে। যেখানে অলসতা আছে সেখানেই আলোচনা সমালোচনা এবং অন্যের দোষ নিয়ে চর্চা করার যথেষ্ট সুযোগ থাকে। আমরা বাঙ্গালীরা ঠিক সে সুযোগটাই নিই। বেশী ভাগ্যের উন্নয়ন চেষ্টা করলে আমাকে বেশী পরিশ্রম করতে হবে। ফলে অবসর না থাকায় অন্যের দোষ ধরার সুযোগ থাকবে না।

বাঙ্গালীদের মাঝে আত্ম সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। তাই সমালোচনায় আগ্রহ বেশী তাও আবার খারাপ দিকগুলোর প্রতি উৎসাহ অনেক। গঠনমুলক সমালোচনায় দোষ নেই বরং কাজের স্বচ্ছতা বাড়ে। একটি ভালো কাজে উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়ে কাজের গতিকে বাড়ানো যায়। এতে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ তথা জাতি অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায়। অথচ আমরা সে দিকে এক ধাপও যেতে চাই না। চায়ের টেবিলে, পাড়ার মোড়ে, বিভিন্ন সভা, সেমিনারে, মিডিয়ার টক শো তে হাজারো নেতিবাচক সমালোচনা হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, খুব কম সংখ্যক সমালোচনায় ভালো দিকগুলো তুলে ধরা হয়। বিষয়টি এমন যেন অন্যের দোষ ধরা প্রধান কাজ। এসব ক্ষেত্রে একবারও ভাবি না, আমি নিজে কতটা সঠিক বা ভালো।

স্বার্থপরতা ও হিংসুটে মনোভাবটা আমাদের জন্মগত। মাঝে মাঝে আমরা এতোটা বিচার বুদ্ধিহীন এবং বিবেকহীন হই যে অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করার বেলায় সরাসরি মিথ্যার আশ্রয় নিই। আমরা বেশী ভাগ সাধারণ মানুষ, চিলে কান নিয়ে গেল, এ প্রবাদে বিশ্বাসী হয়ে মিথ্যার পিছনে ছুটতে থাকি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমরা কোন চিন্তা করি না এবং বিবেককে কাজে প্রয়োগ করি না। এ সব ক্ষেত্রে আমরা সবাই মিথ্যার আশ্রয়ে অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করে তার চরম সর্বনাশ করি। প্রচন্ড রকম হিংসাবোধের কারণে কারও ক্ষতি করতে আমাদের বিবেকে একটুও বাঁধে না। এমন মনোভাব শুধু আপনার আমার নই, আমাদের সকলের।

আয়নায় নই, নিজের মনের চোখে সবাই যদি নিজেকে দেখত, তা হলে হয়তো ভাল হত। আর কিছু না হোক, তখন আমার চোখেই আমার অনেক দোষ ধরা পড়ত। নিজের বিবেকের ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। আসলে অন্যের দোষ সহজে আমাদের চোখে পরার বিশেষ কারণ আছে। আমাদের এ চোখ দুটি অন্যকে দেখতে অভ্যস্ত, নিজকে নই। আমাদের চোখ দিয়ে আমরা নিজেদের খুব কমই দেখি। এটা সাজগোজ, কিছু পরিধানে বা চুল আঁচড়ানো ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। নিজের কাছে সব সময় নিজেকে সঠিক মনে হয়। তাই নিজেদের বড় বড় দোষগুলো আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়।

আমাদের নিজেকে সঠিক ভাবে বিচার করা, দেখা বা অন্যের সাথে তুলনা করা দরকার। তখন আমার দোষও আমার চোখে ধরা পরবে। সব চেয়ে বড় সত্য হলো, অন্যের দোষ ধরে অন্যের ক্ষতি করে আমরা লাভবান হবার চেষ্টা করি। হিংসাত্বক মনোভাব চরিতার্থ করে এক ধরনের ঘৃণ্য আত্মতৃপ্তি লাভ করি। এখানে নিজের দোষ ধরলে আমাকে সংশোধিত হতে হবে। তখন লোকের চোখে আমার দোষ প্রকট হয়ে উঠবে এবং নিজের দোষের মাসুল গুনতে হবে। তাই আমরা অন্যের দোষে বিচারপতি এবং নিজের দোষে উকিল সাজি।

আমরা অন্যের দোষে বিচারক এবং নিজের দোষে উকিল সাজি!

কারও জন্য নই, শুধু মাত্র নিজের জন্য হলেও খারাপ মানসিকতা বাদ দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নিজের মানসম্মান এবং ব্যক্তিত্ববোধ সমুন্নত থাকবে। দোষ ধরে পরচর্চায় কি লাভ? আর যেহেতু অন্যের সমালোচনা বা দোষ ধরে সাধারণ ভাবে আমাদের লাভবান হবার সুযোগ নেই। তাই সার্বিক ভাবে এ জঘণ্য পথ বর্জন মঙ্গলকর। কারও দোষ ধরে সুযোগ সন্ধানী হিসেবে কেউ কেউ হয়তো ফায়দা লুটতে পারে, তবে সবাই না। তাদের ক্ষেত্রে হাজারও উপদেশ বাণী বা উপমা উদাহরণে কোন কাজ হবে না, এটা নিশ্চিত। যার যে কাজ করা উচিত সেই কাজের প্রতি শতভাগ ইচ্ছা থাকতে হবে। তাহলেই সার্বজনীন এবং বেশী মঙ্গল নিশ্চিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত পায় না কারণ সবাই সময়ের সঠিক ব্যবহারে ব্যস্ত। তাই তারা আজ এতো উন্নত এবং উন্নয়নের শীর্ষে অবস্থানরত। আসুন আমরা আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে বরং নিজের সমালোচনা করে উন্নতির সঠিক পথে এগোই। একান্ত প্রয়োজনীয় না হলে পরনিন্দা, পরচর্চা এবং অন্যের দোষ ধরার পথ পরিহার করি

Leave a Reply